মোঃ রাসেল সরকারঃ অনিয়মকে ভর করে চলছে রাজধানীর তেজগাঁয়ে অবস্থিত জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট হাসপাতালটি।
আউটসোসিং পদ্ধতিতে জনবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ খাতে সরকারি অডিটেও আর্থিক বড় দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, অনিয়ম হয়নি। এটি একটি ফলস্ (মিথ্যা) অডিট ছিল। তাতে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আউটসোর্সিং কর্মচারি নিয়োগ না হওয়া সত্তেও কর্মী নিয়োগ দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে সরবরাহকারীকে বেতন ভাতা পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা-২০১৮ এর শর্ত লঙ্ঘনপূর্বক আউটসোর্সিং কর্মীদের বেতন ভাতা বাবদ অনিয়মিতভাবে ২ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৭৯ টাকা পরিশোধ করা হয় বলে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উঠে আসে।
স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের সুপারিশে বলেছে, অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিকট হতে আপত্তিকৃত অর্থ আদায়পূর্বক সরকারি কোষাগারে জমা করা আবশ্যক। আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অনিয়ম রোধে মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত দুই অর্থবছরে এ পদ্ধতিতে সেখানে ১১১ জনের নিয়োগ হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে ৬০ জনকে নিয়োগ দেখিয়ে বেতন বাবদ পরিশোধ করা হয় ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা।
স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, এ তিন মাসে ৬০ জনের কোন নিয়োগ হয়নি। জানুয়ারিতে তাদের নিয়োগ দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের নিয়োগ দেয়া হয় ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে।
অথচ গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জালিয়াতির মাধ্যমে বেতন বাবদ ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৪২ টাকা পরিশোধ করা হয়। এতে সরকারের বিরাট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে নিয়মানুযায়ী, আউটসোর্সিং কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ হবে তাদের ব্যাংক হিসাবে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করেছে গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। ১১১ কর্মীদের সরকার নির্ধারিত বেতন সর্বনিম্ন ১৭ হাজার ৬১০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৯ হাজার ১১০ টাকা দেয়ার কথা। কিন্তু কর্তৃপক্ষের যোগসাজসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনেক কর্মীকে ২ হাজার টাকা করে কম পরিশোধ করে।
জানা গেছে, আউটসোর্সিং জনবল সরবরাহকারীর জনপ্রতি সরকার নির্ধারিত সার্ভিস চার্জ হচ্ছে ৫ শতাংশ। কিন্তু বিল পরিশোধ দেখানো হয়েছে ১৫ শতাংশ। তবে নিরীক্ষায় এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র দেখাতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে সরকারের ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৬৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রশাসনিক অনুমোদন ব্যতীত ৪৩ জন আউটসোর্সিং কর্মচারীর বেতন বাবদ অনিয়মিতভাবে পরিশোধ হয় ১ কোটি ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৪৫৭ টাকা।
প্রতিবেদনে নিরীক্ষার মন্তব্যে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৩টি পদে আউটসোর্সিং কর্মচারি নিয়োগের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে পরিচালক তার মনঃপুত লোককে নিয়োগ দেন গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেডের সঙ্গে যোগসাজশে। তিনি ইচ্ছা হলেই কর্মী ছাঁটাই করেন। আবার নুতন করে লোক নিয়োগ দেন। এতেও তার আর্থিক লাভ হয় বলে বিভিন্ন সময়ে অন্যায় ভাবে ছাঁটাইয়ের শিকার এমন কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন। তাদেরকে কর্মে পুনঃবহালেও দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, এসব অনিয়মের সঙ্গে ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোঃ আবু হানিফ ও প্রধান সহকারী মোঃ শরীফুল ইসলামের সম্পৃক্ততা রয়েছে। পরিচালকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শরীফুল ইসলাম ছিলেন হাসপাতালটির ক্যাশিয়ার। তাকে নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) অনুমোদন ছাড়াই প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতি দেয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোঃ আবু হানিফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, অনিয়ম হয়নি। এটি একটি ফলস্ (মিথ্যা) অডিট ছিল। মন্ত্রণালয় আমাদেরকে কাগজপত্র জমা দিতে বলেছে। প্রমাণসহ জবাব দিয়েছি। অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কিছু বাকী আছে। মন্ত্রণালয় সন্তোষ্ট হয়েছে। এই আন্ডার অডিট নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট হয় না বলে তিনি মন্তব্য করেন। পরিচালক আরও বলেন, এখানে একটি দুষ্ট চক্র ছিল। তারা এগুলো করে বেড়ায়।
স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর সূত্রে জানায়, এ নিরীক্ষা আপত্তির বিষয়ে ইনস্টিটিউটের পরিচালককে কয়েক দফায় চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অডিট অধিদপ্তর। কয়েকবার সময় ক্ষেপন করে জবাব দিয়েছেন তিনি। তবে কি জবাব দিয়েছেন তা বলতে পারেননি স্বাস্থ্য অডিট সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র।
গালফ সিকিউরিটিজ সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএস খান স্বপন এ বিষয়ে বলেন, যে তিন মাসের বেতনের অডিট আপত্তি দিয়েছে তখন করোনার পিক টাইম ছিল। ফলে ব্যাংক একাউন্ট খুলতে পারেনি কর্মীরা। তখন কর্মীরা হাতে নগদ টাকা তুলেছেন স্ট্যাম্পের মাধ্যমে। হাসপাতালের ফান্ডেও টাকা ছিলনা। ওই সময় কোম্পানির নিজস্ব ফান্ড থেকে কর্মীদের বেতন বাবদ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। পরে হাসপাতালে এ খাতের ফান্ড চলে আসলে তা কোম্পানিকে ফেরত দেয়া হয়। ৫ শতাংশ চার্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী চার্জ হয়েছে। এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত চার্জ করা যায়। সেই হিসাবেই করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ৬০ জন এবং ৪৩ জনের আলাদা আলাদা টেন্ডার হয়েছে।