চট্টগ্রাম প্রতিনিধিঃ বিনোদনের প্রয়োজনে নিজেদের উপনিবেশিক অঞ্চলে ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতো ব্রিটিশ বেনিয়ারা। সে সব ক্লাবে কেবল তাদেরই প্রবেশাধিকার থাকতো। বসাতো নাচ-গানের জলসা, মদের আসর। খেলা হতো জুয়া। এমনই দুটি প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকা ক্লাব ও চট্টগ্রাম ক্লাব। দুটি ক্লাবই সে সময়ের অভিজাত প্রতিষ্ঠান। আর অভিজাত মানেই তখন ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় কর্মকর্তা। স্থানীয়রা সেখানে ছিলো অচ্ছুৎ।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বেনিয়ারা বিতাড়িত হওয়ার পর ক্লাব দুটির অভিজাত সম্প্রদায়ের সজ্ঞাও বদলে যায়। আভিজাত্যের আসনে আসীন হয় পাকিস্তানি কর্মকর্তারা। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারাই তখন ক্লাবটির সুবিধা ভোগ করতো। তাদের দয়ায় স্যুট-কোট পরার সুযোগ পাওয়া এ দেশীয় দোসরদেরও মাঝেমধ্যে ডাক পড়তো ক্লাবে।
তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্লাব হয়ে উঠলো সদ্য স্বাধীন দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ধনীদের এন্টারটেইনমেন্ট ভেন্যু। নিজেদের স্বার্থে বেনিয়াদের গড়া নিয়ম-কানুন যেমন পাকিস্তানিরা চালু রেখেছিলো, তেমনি বাংলাদেশের অভিজাতরাও ক্লাবের চৌহদ্দিকে ব্রিটিশ নিয়মের সংরক্ষিত জোনই করে রাখলো।
স্যুট, কোট পরে ক্লাবে যেতে হয়। দেশীয় ঐতিহ্যের পাজামা, পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল পরে ঢোকা যায় না। বাংলাদেশের বুকে যেনো ব্রিটিশ রাজত্বই চালু রইলো। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব ক্লাবে ঢুকতে গিয়ে অপমাণিত হয়ে ফিরে গেলেন? ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে লুঙ্গি পড়ে ঢাকা ক্লাবে ঢুকতে না পেরে বেজায় ক্ষেপলেন ফরহাদ মজহার। কিন্তু ঢাকা ক্লাবের কর্তারা ব্রিটিশ ড্রেস কোডের পক্ষে অনঢ় রইলেন।
ব্যাপক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সমালোচনার মুখে একসময় ঢাকা ক্লাবের ড্রেস কোডে কিছু পরিবর্তন এলো। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পাঞ্জাবি, পায়জামা ও স্যান্ডেল সু পরে এখন ঢোকা যায় ঢাকা ক্লাবে। কিন্তু এশিয়ার প্রাচীনতম অভিজাত ক্লাব হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম ক্লাব এখনও ও পথে হাঁটতে আগ্রহী নয়। যেহেতু সময়ের হিসেবে তারাই আগে থেকে ব্রিটিশ আভিজাত্য বইছে, তাই সেই আভিজাত্য টিকিয়ে রাখতে তাদের গোঁয়ার্তুমিও বেশি।
তারা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককেও দরোজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। তার মতো অনেকেই পাঞ্জাবি পরার কারণে ক্লাব গেট থেকে অপমাণিত হয়ে ফিরে গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, কয়েক বছর আগে প্রাইম ব্যাংকের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন দেশের স্বনামধন্য একটি শিল্প গ্রুপের চেয়ারম্যান। পাঞ্জাবি পরায় তাকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিলো। পাঞ্জাবি পরায় একজন ব্যবসায়ীকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো। বিষয়টি নিয়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল।
ট্রাস্ট ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান মিজানুর রহমান তখন বলেছিলেন, ভেন্যু ভাড়ার সময় আমাদের ড্রেসকোডের বিষয়ে বলা হয়নি। স্বাধীন দেশে ব্রিটিশদের গোলামি নিয়ম থাকা উচিত নয়; পরিবর্তন করা জরুরি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর আক্ষেপ আরও বড়। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ক্লাব অনেকাংশে ভূমিদস্যু ও নষ্ট মাফিয়াদের দখলে। আমি আর যাই না সেখানে। এখন আমার সদস্যপদও নেই। ঘৃণা, প্রচণ্ড ঘৃণা তাদের প্রতি।
ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন অব চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড ও সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে ক্লাবের বাই-লজ অনুযায়ী ক্লাব পরিচালিত হয়। সেটাতে পরিবর্তন আনতে হলে ইজিএমের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নির্বাচিত কমিটি বাই-লজে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন বা সংশোধন আনতে পারে। তাহলে ড্রেস কোডের পরিবর্তনের উদ্যোগ চট্টগ্রাম ক্লাব কেনো নিচ্ছে না? ঢাকা ক্লাবের উদাহরণ অনুসরণ করতে দোষ কোথায়।
চট্টগ্রাম ক্লাবের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ ছালাম বলেন, ক্লাবটি ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত। তাদের অনেক নিয়ম টেনে নিয়ে যাচ্ছি। ড্রেসকোডও সে রকম একটি। তবে চাইলে এ নিয়ম পরিবর্তন করা যায়। ঢাকা ক্লাব নিয়ম পরিবর্তন করে পাঞ্জাবি অ্যালাউ করেছে।
সুশীল সমাজের দাবি, চট্টগ্রাম ক্লাবেও ড্রেস কোড পরিবর্তন করে দেশীয় ঐতিহ্যকে মর্যাদার স্থান দেওয়া হোক।