জামালপুর প্রতিনিধি : ভাদ্রের তালপাকা কাঠ ফাঁটা রোদের তাপমাত্রা যতো বাড়তে থাকে মিনহাজের আখের রসের দিকে ততো আসতে থাকেন সব স্থরের মানুষ। কেউ এক গ্লাস। আবার কেউ দুই গ্লাস করে ঢগ ঢগ করে গিলে তৃষ্ণা নিবারণ করেছে। আবার স্কুলের শিক্ষার্থীরা পানি নেয়ার পাত্রে ভরে নিয়ে যাচ্ছে। দেশীয় জাতের আখের চিরচেনা সুগন্ধী মিষ্টি সুবাসের সবুজ রঙের রস বিক্রি করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে তিনি আজ স্বাবলম্বী।মিনহাজ উদ্দিনের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মালঞ্চ গ্রামে। তার বাবার নাম বাদশা মিয়া। মিনহাজ ছাড়াও তার আরো একটি ভাই, দুই বোন রয়েছে। ২৮ বছর বয়সি বিবাহিত জীবনে তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক।
মিনহাজ আগে ঢাকার গাজীপুরে পোষাক কারখানায় চাকরি করে অতিকষ্টে জীবন যাপনের ফলে তিনি পেশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। ঢাকার ধালাইখাল থেকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একটি ব্যাটারি চালিত আখ থেকে রস বের করার মেশিন বানিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করেছেন।
মিনহাজ জানান, প্রতিদিন তিনি ৭০ থেকে ৮০ পিস আখ বিক্রি করেন। প্রতি আখ থেকে ৬ থেকে ৮ গ্লাস পর্যন্ত রস হয়। প্রতি গ্লাস রসের মূল্য ১০ টাকা হারে প্রতি আখ থেকে ৬০ টাকা থেকে ৮০ টাকা বিক্রি করা যায়। এক বছর ধরে তিনি আখের ব্যবসা করছেন। এর আগে তিনি কচি ডাবের ব্যবসাও করেছেন।
সদ্যাহাসোজ্জ্বল টগবগে যুবক মিনহাজ আরো বলেন, আখের মধ্যেও ভালো মন্দ আছে। পাশের জেলা শেরপুর থেকে আখ কিনলে রস বেশি ও রঙ সঠিক সবুজ হয়। আবার সরিষাবাড়ির ভাটারা থেকে আখ কিনলে রস কম হয়। রঙ সবুজ হয় না। কাস্টমার একবার খেলে আবার খেতে চায় না। রসের রঙ পঁচা নালির মতো হয়। এ ধরনের আখে ২ হাজার টাকা বিক্রি করলে ১২ থেকে ১৫শ টাকা লাভ হয়। কিন্তু গ্রাহক মন খারাপ করে। তাই লাভ একটু কম হলেও শেরপুর থেকেই আখ নিয়ে আছি। এছাড়া রস বের করার পর আখের যে ছাল অবশিষ্ট থাকে তা লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মিনহাজ বলেন, এটি মূলত সিজনালী ব্যবসা। ৭ থেকে ৮ মাস ধরে এ ব্যবসা চলে। শেরপুরের ঝিনাইগাতির ভালুকা থেকে ১০ শতাংশ জমি ৩০ হাজার টাকায় ১৮শ আখ কিনেছেন। এতে প্রতি পিস আখের মূল্য পড়েছে ৩২ টাকা। তবে খুচরা কিনলে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পিস পড়ে। কিন্তু আখ ভালো হয় না। ক্ষেত থেকে আখ কাটতে ১২শ টাকা দিয়ে দুটি শ্রমিক দিয়ে ৮শ আখ কাটা হয়। ৩ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে সেই আখ ভ্যানগাড়িতে করে মালঞ্চ বাড়িতে আনা হয়। বাড়িতে এনে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ পিস করে টুকরো টুকরো পিস পিস করে সাজিয়ে গ্রাহকের চাহিদা মতো রস করে বিক্রি করা হয়।
জামালপুর শহরের প্রধান সড়ক মেডিকেল রোডের সিংহজানি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের গেটের সামনে রস ভাঙানোর মেশিন নিয়ে বসেছেন। পাশেই সোনালী ব্যাংক থেকে নেমে ঢগ ঢগ করে এক গ্লাস রস পেটে পুরে পিপাসা মিটিয়ে ঢেকর তুলছেন শাহীন। তিনি জানান, মিনহাজের রস আদি ও আসল স্বাদে ভরপুর। তিনি যখনই আসেন রস নিয়ে আসেন ইচ্ছামতো খেয়ে নেই। পাশেই বাংলাদেশ খেলাঘরের মালিক নজরুল ইসলাম ও রস খেলেন। স্কুল ছুটির পর তাসফিয়া পানির পাত্রে ভরে নিলেন তিন গ্লাস। ছোট্ট খাকা নাফিও খেলেন এক গ্লাস।
রিকশা থেকে নেমে আসলেন মনজুরুল, সুজন ও মানিক। সবারই দাবি সময় নেই। তাড়াতাড়ি দেন। তারা জানান, আখের রসের নানা গুনাগুন রয়েছে। প্রচণ্ড রোদে এক গ্লাস রস পান করলে শরীরের সমস্ত তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়। শরীর হয় ঠান্ডা সুশীতল। আখের রস শুধু তৃষ্ণা মিটাতেই কাজ করে না। এতে রয়েছে নানা ধরনের গুনাগুণ।
জামালপুর সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ আফিসের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলরুবা ইয়াসমিন জানান, আখের রস খুব সহজলভ্য এবং খুব উপকারী একটি পানীয়। আখে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে। দেহের টক্সিন নির্মুল করে প্রচুর এনার্জি বুস্ট করবে এই সুস্বাদু পানীয়। শুধু তাই নয়, আখের রসে রয়েছে প্রচুর ফাইবার এবং মাইক্রো-মিনারেলস।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আখের রসের উপকারিতাও রয়েছে। জন্ডিস, রক্ত স্বল্পতা, অম্বল জাতীয় রোগ, গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, লিভার ভালো রাখে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ওজন কমায়, ত্বক উজ্জ্বল রাখে, ব্রণ দূর করাসহ আখের রসে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন এবং পটাশিয়ামের মতো উপাদান থাকায় হাড় শক্ত করার কাজে সহযোগিতা করে।