ফিচার প্রতিবেদক : দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রাণী বলা হয় শকুনকে। বলা হয় প্রকৃতির ঝাড়ুদারও! এক সময় শকুনকে মানুষ অশুভ মনে করেছে। মানুষের কাছে এটি মোটেই পছন্দের কোন পাখি নয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে শকুন পরিবেশের জন্য আর্শিবাদ স্বরুপ। এক কথায়, ভীষণ উপকারী। কারণ মৃত পশুর দেহ ও আবর্জনা হচ্ছে শকুনের প্রধান খাদ্য।
আশির দশকের শেষ সময় থেকে নব্বই দশকের শেষ সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ শকুন বিলুপ্ত হয়েছে। ওই সময় মাত্র ১০ থেকে ১৫ বছরের ব্যবধানে হুট করেই দেশের আকাশ থেকে হারিয়ে যায় শকুন। এমন দাবি করছেন পাখি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এস এম ইকবাল। শকুন প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ায় পরিবেশ নানাভাবে বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। ফলে পরিবেশবিদদের মধ্যে দিন দিন উৎকন্ঠা বাড়ছে।
শকুন এই পৃথিবীতে আছে অনেক আগে থেকে, প্রায় ২৬ লাখ বছর ধরে। শকুনের সাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এদের মাথায় পালক নেই, তাদের চঞ্চু খুব ধারালো, এরা ময়লার ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খায়। অনেক উপর থেকে এরা মৃত পশুর দেহ দেখতে পায়, তারপর সেখানে নেমে আসে, তারপর সেই মৃত পশুর দেহ দ্রুত সাবাড় করে। তাদের পাকস্থলীর জারণ ক্ষমতা অসাধারণ। মৃত পশুর দেহ তো বটেই, তাদের হাড় পর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারে শকুন।
১৯৭০ এবং ১৯৮০র দশকে শকুনের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, ভারত বা পাকিস্তানের মতো দেশে শকুনকে একটা উপদ্রব বলে গণ্য করা হতো, এগুলোকে যে সংরক্ষণ করা দরকার, সেটার কথা কারও মাথাতেই ছিল না।
মুনির ভিরানি তখন এক তরুণ রিসার্চ বায়োলজিস্ট, শকুন নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ। তিনি বলছিলেন, তখন এই শকুনের সংখ্যা যে হারে কমছিল, তা আসলেই ভয়াবহ। পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গেল যে, লোকজন যেন হঠাৎ চারিদিকে তাকিয়ে টের পেল, আকাশ একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে, কোথাও আর শকুন নেই।
ধারণা করা হয়, ৭০ এর দশকের শুরুর দিকে ভারতের জয়পুর-আগ্রা এবং দিল্লির মধ্যবর্তী অঞ্চলেই কেবল ৪ কোটি এরকম শকুন ছিল। ভারতের হিন্দুরা গরুকে পবিত্র বলে মনে করে এবং এর মাংস খায় না। কাজেই যখন গরু মারা যায়, তখন সেই মৃত গরুর একটা ব্যবস্থা করতে হয়। এই সমস্যার সমাধানে শকুন একটি খুবই প্রাকৃতিক এবং দক্ষ ভূমিকা পালন করতো।
মুনির ভিরানি বলেন, যখন গরু মারা যায়, তখন এগুলোর মৃতদেহ কোথাও ফেলে আসতে হয়। কাজেই গরু মারা যাওয়ার পর একটি ভাগাড়ে তার দেহ ফেলে দেয়া হয়। সেই ভাগাড়ে থাকে শত শত শকুন। এটি খুবই পরিবেশ সম্মত এক সমাধান। কারণ এখানে আপনাকে কাঠ জ্বালিয়ে গরুর দেহ পোড়াতে হচ্ছে না, আপনি কোন কার্বন দূষণ ঘটাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, আপনি একটি প্রাণীর দেহ দান করছেন আরেকটি প্রাণীকে। সেই প্রাণী আপনার সব কাজ করে দিচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই সেবা আপনি পাচ্ছেন একেবারে বিনামূল্যে। আর শুধু পশুর মৃতদেহ নয়, বৌদ্ধ এবং জরোয়াসথ্রিয়ান ধর্মের অনুসারীরা তাদের কেউ মারা গেলে সেই দেহও ফেলে দেয় শকুনের জন্য। শকুন এসে এই দেহ খেয়ে ফেলে।
একজন ভারতীয় শকুন বিশেষজ্ঞ ড. ভিবু প্রকাশ একদিন খেয়াল করলেন, শকুনের সংখ্যা যেন আগের মতো নেই। ১৯৯৬ সালে তিনি ভারতের একটি ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে খুব কম শকুনই সেখানে দেখতে পেলেন। অনেক শকুন মরে পড়ে ছিল। তারপর তিনি আশে-পাশের গ্রামে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা তাকে জানালেন, পুরো অঞ্চল থেকে শকুন উধাও হয়ে যাচ্ছে।
মুনির ভিরানি যখন ২০০০ সালে ভারত সফরে গেলেন, তখন পরিস্থিতি আরও গুরুতর। তিনি বলেন, ততদিনে শকুন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং আমার মনে আছে, আমি দেখেছিলাম গাছে গাছে মরা শকুন ঝুলছে। খুবই বিচলিত হওয়ার মতো এক দৃশ্য। এটা বলা যেতে পারে তাদের সংখ্যা ৯৯ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ায় শকুন বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে বলে একটা আশংকা তৈরি হলো। মুনির ভিরানি এবং পেরেগ্রিন ফান্ডে তার অন্য সহকর্মীরা তখন এর কারণ খোঁজার চেষ্টা শুরু করলেন। তখন শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য অদ্ভুত সব কারণের কথা বলা হচ্ছিল।
এরপর এই গবেষক দল শকুন মারা যাওয়ার একটা অভিন্ন সূত্র খুঁজে পেলেন। মুনির ভিরানি বলেন, এসব পাখি আসলে মারা যাচ্ছিল কিডনি বিকল হয়ে। আমরা যখন এই শকুনের দেহ ব্যবচ্ছেদ করলাম, তখন দেখলাম, তাদের পাকস্থলী, ফুসফুস, কিডনি, লিভার- এগুলো চকের মতো সাদা আঠালো পিণ্ডে আবৃত। এটি আসলে ইউরিক এসিড। কিডনি থেকে তা বেরিয়ে এসেছিল। কাজেই আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এই শকুন আসলে কি খাচ্ছে, সেটা আমাদের দেখতে হবে। আমরা এমন কিছুর সন্ধান করছিলাম, যেটা সহজলভ্য, সস্তা, যেটা হয়তো দোকানে গিয়েই কেনা যায়, যেটা সর্বত্র আছে, এবং যার কারণে পাখির কিডনি বিকল হতে পারে। আমরা দেখলাম, এটা আসলে ডাইক্লোফেনাক।
ডাইক্লোফেনাকের নাম হয়তো অনেকে শোনেনিই নি, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় যারা গবাদিপশু পালে, তাদের কাছে এটা খুব পরিচিত নাম। ডাইক্লোফেনাক খুব কার্যকর একটি ব্যথানাশক। ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে এটি পেটেন্ট করা হয়। এটি ছিল খুবই সস্তা। দোকানে গিয়েই কেনা যেত। এক বোতল ওষুধ মাত্র দশ সেন্টে পাওয়া যেত। এটা গবাদিপশুর ওপর নির্বিচারে ব্যবহার করা হতো।
মুনির ভিরানি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় গবাদিপশু দিয়ে লাঙ্গল টানা হয়, ক্ষেতের ফসল বাজারে নেয়া হয়। কোন গবাদিপশু যখন একটু খোঁড়াতে থাকে, তখন তার শরীরে এই ডাইক্লোফেনাক ইনজেকশন দেওয়া হয়। এটি দিয়ে রোগ নিরাময় করা যায় না, এটা কেবল ব্যথা কমায়। কাজেই যখন পশুটা মরে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, তখন তার সমস্ত শরীরে কিন্তু ডাইক্লোফেনাকের অবশেষ থেকে যাচ্ছে। যখন শকুন এই পশুর মৃতদেহ খেতে আসছে, তখন সেটি যেন একটা আত্মহত্যার ভোজ উৎসব হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ সরকার শকুন রক্ষার তাগিদে এরই মধ্যে ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রফেন জাতীয় ওষুধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। বিপর্যয়ে পড়া এই শকুন সংরক্ষণ এবং বংশবৃদ্ধির তাগিদ থেকে গোটা বিশ্বে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে আসছে।
আইইউসিএন-এর ২০১৪ সালের জরিপ মতে, আমাদের এই উপমহাদেশে এক সময় ৪০ লাখ শকুন ছিল। সেই সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১১ হাজারে। আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা এখন ২৬০টি। বাংলাদেশের সিলেট এবং সুন্দরবন অঞ্চলে এই ২৬০টি শকুন টিকে আছে।
আমাদের দেশে এক সময় ৭ প্রজাতির শকুন দেখা যেতো। এর মধ্যে রাজ শকুন বাংলাদেশ থেকে একেবারেই বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলা শকুন বেশি টিকে আছে। সেই সঙ্গে আরেকটি প্রজাতির শকুন হচ্ছে সরুঠোটি শকুন। এই প্রজাতির শকুন সর্বসাকুল্যে মাত্র ৮/১০টি রয়েছে বাংলাদেশে। এছাড়াও দেশে মাঝে মাঝে আরো তিন প্রজাতির পরিযায়ী শকুন দেখা যায়। তার মধ্যে ‘হিমালয়ান গৃধিনী’ অন্যতম। হিমালয়ে অস্বাভাবিক ঠান্ডা পড়লে এরা বাংলাদেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়, নীলফামরী, দিনাজপুর এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। এরা মূলত নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে আসে এবং মার্চের দিকে আবার ফিরে যায়। পরিযায়ী শকুন প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এসে এরা খাবারের সংকটে পড়ে যায়। সংগত কারণেই শীতের ওই সময়ে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় এদের অসুস্থ হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
প্রতিবছর ‘হিমালয়ান গৃধিনী’ জাতের শতাধিক শকুন এ দেশে আসে। যার মধ্যে চল্লিশ শতাংশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ধরণের শকুন উদ্ধারের জন্য ২০১৪ সালে আইইউসিএন একটি প্রকল্প নেয় দিনাজপুরের সিংড়ায়। গড়ে তোলে “শকুন উদ্ধার ও পরিচর্যা কেন্দ্র”। গত ছয় বছরে এখানে ৯৯টি শকুন উদ্ধার করে অবমুক্ত করা হয়েছে।