চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ট্রেন যাবে কক্সবাজার। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ দিনের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে আগামী বছর। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছরের জুনে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইনের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এরপর জুলাই বা আগস্টে চালু করা হবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব সড়ক পথে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। সেই ১৫০ কিলোমিটারের দূরত্ব থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার কমে ১০২ কিলোমিটারে চলে আসছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের কারণে। যার ফলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মত সময়ও কমে আসবে। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম চট্টগ্রাম থেকে রামু হয়ে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম রেল প্রকল্পের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। কক্সবাজারে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক এবং নান্দনিক এক আইকনিক রেলওয়ে স্টেশন। চট্টগ্রাম-দোহাজারীর বিদ্যমান ৪৭ কিলোমিটার রেললাইনের বাইরে ইতোমধ্যে চকরিয়া, রামু, ঈদগাঁও, নাপিতখালি অঞ্চলে প্রায় ৪২ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চুনতিসহ আরো কয়েকটি স্থানে ব্রিজ, কালভার্ড, রেললাইন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের প্রায় ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বৃহৎ এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দেশের অর্থনীতির গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি সড়কপথের পাঁচ/ছয় ঘণ্টার দূরত্ব থেকে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিমি, রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিমি এবং রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের জন্য নিরাপদ, আরামদায়ক, সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রবর্তন হবে। সহজে ও কম খরচে দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত মাছ, লবণ, কাগজের কাঁচামাল, বনজ ও কৃষিজ অন্যান্য পণ্য পরিবহনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
প্রকল্প সূত্রে আরও জানা গেছে, মোট ১২৮ কিমি. রেলপথে স্টেশন থাকছে ৯টি। এগুলো হলো, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও ঘুমধুম। এতে থাকবে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। এই রেলপথ নির্মাণের কারণে শঙ্খ, মাতা মুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে ৩টি বড় রেল সেতু। এ ছাড়াও নির্মিত হচ্ছে ৪৩টি ছোট রেল সেতু, ২০১টি কালভার্ট এবং ১৪৪টি লেভেল ক্রসিং। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া এলাকায় তৈরি হবে একটি ফ্লাইওভার, রামু ও কক্সবাজার এলাকায় দুটি হাইওয়ে ক্রসিং।
করোনা পরিস্থিতি, ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা, বিদ্যুৎ লাইন, নিমার্ণ ত্রুটি দেখ ভালসহ বেশ কিছু সমস্যার কারণে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের কাজ শেষ করার চুক্তি থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। এতে প্রকল্পের অসম্পন্ন কাজ গুলো সম্পন্ন করতে আরো দুই বছরের জন্য সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বর্ধিত এ মেয়াদে ২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ করতে সময় বাড়ানো হলেও ব্যয় বাড়ানো হয়নি বলে জানান প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকৌশলী মো. মফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। করোনা মহামারির মধ্যেও দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ থেমে ছিল না। ব্রিজ নির্মাণ, রেল ট্রেক, বিদ্যুৎ লাইন, মাটি কাটার কাজ, রেললাইন গুলোতে সিগন্যালের তার বসানোসহ নানান কাজও চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের প্রায় ৪২ কিলোমিটারের মতো রেল লাইন প্রস্তুত হয়েছে। এই বছরের গত জুলাই মাস পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭৩ শতাংশ হয়েছে।
মফিজুর রহমান আরো জানান, সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে। এরপর বাকি সময় গুলোর মধ্যে এই রেল পথে ট্রেনের ট্রায়াল শুরু হবে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করছি।
অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (এপিডি) আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ বা অন্য কোনো সমস্যা না হলে প্রতিমাসে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত রেল ট্রেক বা রেল লাইন বসানো সম্ভব। রেল লাইনটি দ্রুত নির্মাণের মাধ্যমে যাতায়াত শুরু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ সারাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি আরো বলেন, রেল লাইনটি চালু হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আনা গোনা বৃদ্ধিসহ নানা বিধ বিষয়ে যোগাযোগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং এই অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে।