এম শিমুল খান, দৌলতদিয়া থেকে ফিরে : প্রধান গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার পরই চোখে পড়ল সরু গলির দু’পাশে বসে থাকা মধ্যবয়সী বেশ কয়েকজন নারীর। সবাই খুব পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন। প্রতিটি নারীই স্বাভাবিক সময়ের থেকে একটু বেশি সেজেছে। খদ্দেরের আশায় নিজেদেরকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যেই তাদের এই সাজ বলে জানা যায়। সাজগোজ আর পরিপাটি থাকলেও তাদের সবার চোখে-মুখেই ছিল এক বিষন্নতার ছাপ। এ বিষন্নতা বেঁচে থাকা সংগ্রামের। এক মুঠো ভাতের। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই লুকিয়ে ফেললেন মুখ। কেউ কেউ আবার সরু গলির পাশে রেখে দেওয়া বেঞ্চের উপর থেকে সরে নিজেদেরকে আত্নগোপনে নিয়ে গেলেন অজানা অন্ধাকার গলিতে। তাদের জীবন যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন। সোনালী সূর্যের আলোর ছটা পড়ে না তাদের গায়ে। তাই তো অজানা গন্তব্যে অবিরাম তাদের ছুঁটে চলা ছন্দহীন পথে। প্রতিটি সেকেন্ডেই এদের সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়।
বলছিলাম রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া পূর্বপাড়ায় অবস্থিত যৌন পল্লীর কয়েক হাজার নারীর দুঃস্বপ্নময় জীবনের কথা। যাদের জীবন-জীবিকা এখন চরম সংকটে। ভাটা পড়েছে এদের চলার স্বাভাবিক গতিতে। দ্রব্যেমূল্যের সীমাহীন ঊর্দ্ধগতি আর স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরই পাল্টে গেছে এই পল্লীর বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা।
একটি সূত্রে জানা যায়, যৌনপল্লীতে তালিকাভুক্ত যৌনকর্মীর সংখ্যা বর্তমান ১ হাজার ৩০০ জন। এদের মধ্যে ১ হাজার ৫০ জন নিয়মিত রয়েছে। বাকিরা অনিয়মিত ভাবে থাকেন। এদের বাবুর সংখ্যা ৫৬২ জন, বাড়িওয়ালি রয়েছে প্রায় ৩০০ এবং যৌনজীবীদের শিশুর সংখ্যা ৬০০ জন। এর বাইরেও বয়স্ক নারী ও ব্যবসায়ী মিলে আরও প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস এ পল্লীতে। অর্থাৎ যৌনপল্লীর প্রায় ৫ হাজার বাসিন্দা যারা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই যৌনপল্লীর সাথে জড়িত।
সরেজমিন যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার পুরুষ এ পল্লীতে যাতায়াত করে থাকে। এর মধ্যে স্কুলছাত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশা ও বয়সের মানুষ রয়েছে। এখানকার নারীদের মূল টার্গেট থাকে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আসা ট্রাকচালকরা। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এখানকার অনেক খদ্দের কমে গিয়েছে। যারা দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটটি ব্যবহার করতো তারা এখন পদ্মা সেতু দিয়ে নদী পার হচ্ছে। যার কারণে দৌলতদিয়া ঘাট এখন একেবারেই ফাঁকা থাকে প্রায় সময়। যার কারণে অনেক খদ্দের কমে গিয়েছে। খদ্দের কমে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে এখানকার নারীরা।
যৌনপল্লীর বাসিন্দা রেশমা (ছদ্মনাম) বলেন, এখানকার মেয়েদের প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। একটু মানসম্মত ঘর ভাড়া নিলে প্রতিদিন ভাড়া গুনতে হয় ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিদিনের খাবার খরচ লাগে প্রায় ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। বিদ্যুৎ বিল গুনতে হয় ৫০০ টাকা ৮০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও আরো খরচ রয়েছে। যেমন ওষুধ, পোশাক, বিভিন্ন কসমেটিক। প্রতিদিন দুই হাজার টাকা আয় করা এখন দু:সাধ্য ব্যাপার।
আরেক যৌনকর্মী রুপালী (ছদ্মনাম) বলেন, আগে এই পাড়ায় অনেক খদ্দের আসত। এখন অনেক কমে গিয়েছি। যার কারণে আমাদের আয়ও অনেক কমেছে। একদিকে আয় কমেছে অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে এখন কোন রকম ভাবেই চলতে পারছিনা। এভাবে চলতে থাকলে আমরা কি করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছিনা। এখান থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব তাও পারছিনা। কারণ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়ে কি করবো?
যৌনপল্লীকে ঘিরে গড়ে ওঠা খাবার হোটেল ও রেষ্টুরেন্ট এবং আবাসিক বোডিংয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মালিক বলেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে এই পল্লী অনেক জাঁকজমক ছিল। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোক আসত। বিশেষ করে ট্রাক চালকদের আগমন ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের খুবই বাজে অবস্থা। যৌন পল্লীর নারীরা তো আরো বিপদে। যে ভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে তাতে এরা হিমসিম খাচ্ছে।
যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মুক্তি মহিলা সমিতির (এমএমএস) প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আতাউর রহমান মনজু বলেন, এ সকল নারীদেরকে আলোর পথে আনতে হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সে জন্য সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে এরাও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে।
যৌনকর্মীদের সংগঠন ‘অসহায় নারী ঐক্য’র সভাপতি ঝুমুর আক্তার বলেন, দ্রব্য মূল্যে বৃদ্ধির ফলে শুধু এখানকার নারীরাই না, সবাই কিছুটা সংকটে রয়েছে। এই সংকট উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন।
জীবিকার সংকট নেই জানিয়ে এই নেত্রী আরো বলেন, পদ্মা সেতু চালুর কারণে দৌলতদিয়া ঘাটে কোন প্রভাব পড়েছে কিনা বলতে পারব না। তবে আমাদের এখানে পদ্মা সেতু চালুর জন্য কোন প্রভাব পড়েনি।