এম রাসেল সরকারঃ দেড় বছরের ও বেশি সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। তৃণমূলে অসন্তোষ, ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে পদ বাণিজ্য আর মতানৈক্যর অভিযোগ রয়েছে।
রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা চলছে দেড় বছরের ও বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে। ১৩৯ ওয়ার্ড আর ৫০ থানার একটিতেও নেই কমিটি। নেতৃত্বশূন্যতায় ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড। পদপ্রত্যাশী নেতা-কর্মীরা ভুগছেন হতাশায়। নির্বাচনের আগে নতুন নেতৃত্ব পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখছেন না দায়িত্বশীল নেতারা। অভিযোগ আছে, কমিটি গঠন নিয়ে শীর্ষ নেতাদের ‘মতানৈক্য ও পদবাণিজ্য’র কারণেই এই পরিস্থিতি। এ নিয়ে একাধিবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম থেকে শুরু করে নগরের শীর্ষ নেতারা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে বেশ কয়েকবার আলটিমেটাম দিলেও ফলাফল এখনো পর্যন্ত শূন্য। সর্বশেষ দ্রুত কমিটি ঘোষণা করতে সার্বিক তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রেসিডিয়ামের দুই সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি এবং লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপিকে। তারপরও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কমিটি হবে কি না সেই অনিশ্চয়তা কাটেনি।
জানা যায়, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর। ওই দিন উভয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে চারজনের নাম ঘোষণা করা হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয় প্রায় এক বছর পরে ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অধীনে ২৪টি থানা, ৭৫টি ওয়ার্ড, ৫টি ইউনিয়ন এবং ৪০০টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ইউনিটগুলোতে প্রথমবারের মতো সম্মেলন করে কমিটি দেওয়া হয়েছে। তবে সম্মেলন হলেও কোনো ওয়ার্ড ও থানায় নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। দক্ষিণের চেয়েও খারাপ অবস্থা ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের। এর অধীনে থাকা ৮০২টি ইউনিট, ১টি ইউনিয়ন, ৬৪টি ওয়ার্ড ও ২৬টি থানায় সম্মেলন হলেও কোথাও কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সম্মেলনে আগের কমিটি বিলুপ্ত হওয়ায় ৪৫ দিনের মধ্যে নতুন কমিটি ঘোষণা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো কারণে সেটি সম্ভব না হলে কেন্দ্রের কাছে কারণ ব্যাখ্যা করে সময় বাড়ানোর আবেদন করতে হয়, সেটিও করেননি নগর আওয়ামী লীগের নেতারা। সম্মেলন হওয়ার পর কোথাও বছর, কোথাও মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটি দেওয়া হয়নি এখনো। ফলে বিলুপ্ত কমিটিগুলো নেতৃত্বশূন্য রয়েছে অনেক দিন ধরে।
থানা-ওয়ার্ড সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত নেতারা গণমাধ্যমকে জানান, কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে জমকালো সম্মেলনের পর তাদের কাছ থেকে আর কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। শীর্ষ নেতারা তাদের নিজেদের মতো করে কমিটি করতে চান। এ ছাড়া আরও কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধিও চান কমিটি নিজের মতো করে করতে। তাদের মতানৈক্যের কারণেই কমিটি গঠনে দেরি হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ থানা-ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতারা জানান, আমরা কোন পদে আছি আমরা নিজেরাই জানি না। সম্মেলনের সময় আমাদের সকল থানা ও ওয়ার্ড কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করছে। আমাদের চিঠি দিয়ে জানানো হয়নী যে আমরা সাবেক/বর্তমান/চলতি দায়িত্ব কোন পদে আছি। যে যাহা বুঝছে তার পদ/পদবী সেই ভাবে লিখছে। এতে করে দিন দিন হাসির পাত্র হতে হচ্ছে মানুষের নিকট।
এদিকে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনে একে অপরের বিরুদ্ধে পদবাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। গত ২৮ আগস্ট তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় এ নিয়ে প্রকাশ্যে বাগবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন তারা। দুজন দুজনের ওপর থানা ও ওয়ার্ড কমিটি নিয়ে বাণিজ্য করার অভিযোগ তোলেন। দুজনের মধ্যে এ সময় হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। পরে নগর নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এদিকে সম্মেলনের পরও থানা-ওয়ার্ড কমিটি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ পদপ্রত্যাশীরা। বেশ কয়েকটি থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদপ্রত্যাশী নেতারা জানান, নির্বাচনের আগে কমিটি দিতে না পারলে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে। কারণ নির্বাচনে কার নেতৃত্বে কর্মী-সমর্থকরা কাজ করবেন তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। পদপ্রত্যাশী নেতাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বাড়তে পারে অন্তঃকোন্দল। যার প্রভাব পড়বে নির্বাচনের মাঠে। তবে নির্বাচনের শেষ মুহূর্তে এসে এখন কমিটি ঘোষণা হলে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটি নিয়েও ভাবছে নগর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতারা। নির্বাচনে এর কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কারণ পদপ্রত্যাশীর সংখ্যাটা অনেক। পদবঞ্চিতরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে সাংগঠনিক কাজে আগ্রহ হারাতে পারেন।
আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি ২১ সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে প্রতিনিধি সভায় নির্দেশনা দেন, থানা-ওয়ার্ডের কমিটি হোক বা না হোক, যারা আগে যে দায়িত্বে ছিলেন, তারা আপাতত সেই দায়িত্ব পালন করবেন।