এম শিমুল খান, ঢাকাঃ ১১৫ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে বিআরটিসি। ঋণের টাকায় রাষ্ট্রীয় সড়ক পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসির) প্রায়ই বাস-ট্রাক কিনে থাকে। কিন্তু এসব বাস-ট্রাকের দৈন্যদশা অবস্থা। লাইফ টাইমের কথা বলে ২০১৯ সালে দুই প্যাকেজে মোট ৫০০টি ট্রাক ক্রয় করে বিআরটিসি। যা দুই-তিন বছরই অচল হয়ে ঠাঁই হয় মেরামত কারখানায়।
সূত্র মতে, ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে দ্বিতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাংলাদেশকে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চুক্তি হয়। এ চুক্তিতে ৫৮১ কোটি টাকায় ৬০০ বাস এবং ২১৭ কোটি টাকায় ৫০০ ট্রাক কেনা হয় ভারত থেকে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে বাস-ট্রাক ঢাকায় আসা শুরু করে। আর সব বাস-ট্রাক ২০১৯ এর জুলাই মাস নাগাদ আসা শেষ হয়। এগুলো বিআরটিসি তাদের বিভিন্ন ডিপোতে বরাদ্দ দেয়।
বিআরটিসির কেনা ৫০০টি ট্রাকের মধ্যে ৩৫০টি ধারণ ক্ষমতা ১৫ টন। বাকি ১৫০ ট্রাকের ধারণ ক্ষমতা ১০ টন। প্রথম প্যাকেজে ১৫ টন ধারণ ক্ষমতার ৩৫০ ট্রাক কিনতে ১২৫ কোটি টাকার সংস্থান থাকলেও বিআরটিসি খরচ করেছে ৭৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। আর দ্বিতীয় প্যাকেজে কেনা ১০ টন ধারণ ক্ষমতার ১৫০ ট্রাক কিনতে ৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা সংস্থান থাকলেও ট্রাক গুলো কিনতে বিআরটিসি খরচ করেছে ২৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিআরটিসিতে যে পরিমাণ অর্থের সংস্থান ছিল, দুটি প্যাকেজেই তার চেয়ে অর্ধেক দামে ট্রাক গুলো কেনা হয়েছে।
কমদামে কেনা এবং মান যাচাই না করার কারণে ট্রাক গুলোর ইঞ্জিন ও বডি অনেক দুর্বল। বেশির ভাগেরই বাহ্যিক অংশ এরই মধ্যে ছিদ্র হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে মালপত্র পরিবহন করলে ভিজে যায়। বিআরটিসি ৯৮ কোটি টাকা বাঁচাতে গিয়ে এখন ১১৫ কোটি টাকা ক্ষতির মুখে। এছাড়া এ সব ট্রাক মেরামত করতেও প্রচুর টাকা নষ্ট হচ্ছে। নতুন কেনা ৫০০ ট্রাকের ২০৬টি বর্তমানে আছে বিআরটিসির ঢাকা ডিপোয়, চট্টগ্রাম ডিপোয় রাখা হয়েছে ২৭৬টি। বাকি গুলো রয়েছে বিআরটিসির ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ট্রাক চালক ও সহকারীরা বলছেন এসব ট্রাকে নানা ত্রুটি রয়েছে। ভারত থেকে আসা ট্রাকে টুল বক্সসহ অনেক কিছুই ছিলো না। এ ছাড়া ছাদের উপরে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে উঁচু কোন মালামাল পরিবহন না করার জন্য। বিআরটিসির জন্য ট্রাক সংগ্রহ প্রকল্পটির ওপর সম্প্রতি একটি সমাপ্ত প্রকল্প মূল্যায়ন (পিসিআর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইএমইডি।
আইএমইডি বলেছে, স্থানের চেয়ে প্রায় ৯৮ কোটি টাকা কম দামে কেনা হলেও ট্রাক গুলো নিম্নমানের। অথচ বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে উন্নত মানের ট্রাক কেনা যেত। তাতে এসব গাড়ির স্থায়িত্ব যেমন বাড়ত তেমনি সরকারের কোষাগারেও রাজস্ব আয় হতো প্রচুর।
বিআরটিসির কয়েকজন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন ও পুরনো মিলিয়ে বিআরটিসির বহরে বর্তমানে ট্রাক রয়েছে ৫৯০টি। পণ্য পরিবহন করে ২০২২-২৩ অর্থবছর সংস্থাটি ১৭১ কোটি টাকা আয় করেছে।
তারা আরো জানান, সচল ট্রাক দিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সার, কৃষি উপকরণ, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, কাগজসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদে পরিবহন সেবা দেয়া হচ্ছে। এর বাইরে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ ও আপদকালীন এসব ট্রাক দিয়ে সাশ্রয়ী ভাড়ায় পণ্য পরিবহনে অনন্য ভূমিকা রাখছে বিআরটিসি।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটিসি নতুন বাস আনার কিছু দিন পরেই পানি পড়া এবং ট্রাক ডিপোতে পড়ে থাকার দায়দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে। গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের দোষ নেই। সীমান্তে যারা এসব গাড়ি গ্রহণ করেছে তাদেরকেই তো এর ত্রুটি দেখার কথা ছিল। ত্রুটি নিয়ে গাড়ি কী ভাবে দেশে ঢুকলো। কর্তৃপক্ষ তা কেন দেখেননি। এ দায় অবশ্যই বিআরটিসিকেই নিতে হবে।
মুনাফায় বিআরটিসিঃ বিআরটিসির ট্রাকে বর্তমানে আয় বেড়েছে। সরকারি বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের মতো লোকসানে ধুঁকতে থাকা সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ঘুরে দাঁড়িয়েছে। হাজার কোটি টাকা ঋণের ভারে ন্যুব্জ প্রতিষ্ঠানটি এখন লাভের মুখ দেখেছে। ধারাবাহিক মুনাফা করছে।
গত তিন বছরে বহরে নতুন বাস ও ট্রাক যোগ না হলেও আয় আড়াই গুণ বেড়েছে। এক সময় আট মাস বকেয়া পড়লেও ৮৭৩ জন নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের পরও টানা আড়াই বছর নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন বিআরটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই সাথে অপরাধের শাস্তিও পেতে হচ্ছে।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে বাস, ট্রাক, ওয়ার্কশপ এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি থেকে ৩৪৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে পরিচালন ব্যয় হয় ৩৪৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। ফলে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা মুনাফা হয় বিআরটিসির। ওই মুনাফার কারণ ছিল ভারতের ঋণে (এলওসি) ৫৮১ কোটি টাকায় ৬০০টি বাস এবং ২১৭ কোটি টাকায় ৫০০টি ট্রাক কেনা। পরিচালনায় মুনাফা হলেও তখন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারেনি সংস্থাটি।
২০২১-২২ অর্থ বছর থেকে বিআরটিসি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এই সময়ে বহরে নতুন বাস ও ট্রাক যুক্ত না হলেও ওই অর্থবছরে রেকর্ড ৪৭৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা আয় করে। বিপরীতে খরচ হয় ৪৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকা। মুনাফা হয় ৩৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এই রেকর্ড ভেঙেছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে।
গত অর্থবছরে ৬৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা আয় করেছে সংস্থাটি। খরচ হয়েছে ৫৮৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। মুনাফা হয়েছে ৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাস চালিয়ে বিআরটিসি আয় করেছিল ২৩৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। বাসের সংখ্যা না বাড়লেও গত অর্থবছরে আয় করেছে ৪১১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। বাস পরিচালনায় ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয়েছে ৩৮৬ কোটি ৫৫ লাখ। মুনাফা করেছে ২৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ট্রাক থেকে আগেও মুনাফা করত বিআরটিসি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ট্রাক থেকে সংস্থাটির আয় ছিল ১০৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় করেছে ১৭১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছে ১৫২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। মুনাফা হয়েছে ১৯ কোটি ২১ লাখ টাকা।
রাজধানীর গাবতলি ডিপোর ম্যানেজার জামিল হোসেন জানান, আমাদের বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম স্যার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত আড়াই বছরে বিআরটিসিতে স্বচ্ছতা এসেছে। ব্যয় সংকোচন করা হয়েছে। তাই আয় বেড়েছে। তাই নিয়মিত বেতন দিয়েও মুনাফা করা সম্ভব হয়েছে।