বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকাঃ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মোঃ তসলিম উদ্দীন খানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্ণীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
ওই অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়, মোঃ তসলিম উদ্দিন খান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একজন দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা হিসেবেই পরিচিত। তিনি সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মোঃ তসলিম উদ্দিন খান।
এছাড়া তিনি আওয়ামী সিন্ডিকেট করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে অনিয়ম আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। আওয়ামী লীগের পুরো সময়ই তিনি দুর্নীতি আর লুটপাট চালিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে।
এছাড়া গত জুলাইযের ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মোঃ তসলিম উদ্দিন খান সক্রিয়ভাবে রাস্তায় নেমে ছিলেন। এমনকি ছাত্র আন্দোলন দমানোর জন্য আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নিজের দুর্নীতির টাকা দিয়ে রাস্তায় নামিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ মাইন্ডের এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি, টেন্ডার বাণিজ্য, কেনাকাটা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চালিয়েছেন তার অনিয়ম ও দুর্নীতি।
ওই অভিযোগ পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়,
মো. তসলিম উদ্দিন খান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন এবং কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট মিলে নিয়োগ বানিজ্যের একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অসাধু এই কর্মকর্তা মো. তসলিম উদ্দিন খান অফিসের আসবাবপত্র ও অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানি করাসহ নানা অনিয়নের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত ১২ই জানুয়ারী ২০২৫ ইং তারিখে তাকে বিভাগীয় পরিচালক পরিবার পরিকল্পনা বরিশালে বদলী করা হলেও মাত্র ২ দিনের মধ্যেই বিশাল অংকের ঘুষের বিনিময়ে ১৪ই জানুয়ারি অধিদপ্তরে পরিচালক (আইইএম) পদে যোগদান করেন।
ওই অভিযোগ পত্রে আরো বলা হয়, বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মালামাল বুঝে না নিয়েই পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে চুক্তির পুরো টাকা তুলে নিজেদের পকেটে ভরেছেন অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মোঃ তসলিম উদ্দিন খান এবং প্রাক্তন পরিচালক (এমআইএস) মো. শাহাদাত হোসাইন। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তিমুল্য ১ কোটি ৭৭ লাখ ১৯ হাজার ৯১০ টাকা পরিশোধ করা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো মালামাল বুঝে নেয়নি মোঃ তসলিম উদ্দীন খান।
এ ছাড়া পরিচালক মোঃ তসলিম উদ্দীন খানের কারনে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ কোটিরও বেশি অর্থে সম্পূর্ণ মালামালও এখনও বুঝে পায়নি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
ওই অভিযোগ পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়,
২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পরিবার কল্যাণ সহকারী রেজিস্টার (৯ম সংস্করণ), সাপ্লিমেন্টারি রেজিস্টার ও বিভিন্ন ধরনের এমআইএস ফরম সরবরাহের জন্য নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের। ২০১৮ সালের ৬ জুন এ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার মাত্র ছয় দিনের মাথায় অর্থাৎ ৩০ জুন পুরো টাকা পরিশোধ করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটিকে। চুক্তি অনুযায়ী, আট সপ্তাহের মধ্যে পুরো মালামাল সরবরাহ করার কথা থাকলেও নিয়ম অনুযায়ী মালামাল বুঝিয়ে দেওয়ার পরই পুরো অর্থ পরিশোধের কথা। কিন্তু তা না করেই মোঃ তসলিম উদ্দীন খানের কারনে বিলের সব টাকা পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মোঃ তসলিম উদ্দিন খান ও সাবেক পরিচালক (এমআইএস) মোঃ শাহাদাত হোসাইনের দুর্নীতিতে এসব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ৮ সপ্তাহের মধ্যে সব মালামাল দেওয়ার কথা থাকলেও তা গ্রহণ না করেই মোঃ তসলিম উদ্দিন খান মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মালামান বুঝে পাওয়ার প্রত্যয়ন পত্র এবং কাজের সমুদয় বিল পরিশোধ করেন।
নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কাজটি পেতে সহযোগিজ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের তৎকালীন উপপরিচালক (বৈদেশিক সংগ্রহ) মোঃ শাহাদাত হোসাইন এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (সংযুক্ত-উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিট) মোঃ রফিকুল ইসলাম। তখন শাহাদাত হোসাইন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি ও রফিকুল ইসলাম দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরও ইন্টার-গ্রাফিক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৮ সালের ৬ জুন চুক্তি করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। চুক্তির শর্তমতে, পরিবার কল্যাণ সহকারী রেজিস্টার (১ম সংস্করণ) ৩০ লাখ ১০ হাজার কপি সাপ্লিমেন্টারি রেজিস্টার এবং ৪৯ লাখ ১৯ হাজার ৮৭২ কপি বিভিন্ন ধরনের এসআইএস ফরম সরবরাহ করার কথা ছিল। চুক্তিতে প্রতিষ্ঠানটিকে এসব মালামাল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আট সপ্তাহের সময়সীমা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর চুক্তির ছয় দিনের মাথায় সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করা হয় নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে। কিন্তু বছরের বেশি সময় পার হলেও চুক্তিভুক্ত মালামালগুলো এখনো বুঝে পায়নি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজের সমুদয় অর্থ বুঝে পেতে প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছেন মোঃ তসলিম উদ্দিন খান।
ওই অভিযোগ পত্রে বলা হয়, নিপুন প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এখনও ৪ হাজার ৫০০ কপি পরিবার কল্যাণ সহকারী রেজিস্টার (৯ম সংস্করণ), ২ হাজার ৫০০ কপি সাপ্লিমেন্টারি রেজিস্টার এবং ৩৯ লাখ বিভিন্ন ধরনের এমআইএস ফরম পাওনা রয়েছে। এ ছাড়া রেজিস্ট্রারসহ এসব প্রয়োজনীয় মালামাল না পাওয়ায় তখন মাঠ পর্যায়ের কাজে চরমভাবে সংকটে পড়েন প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে আরেকটি প্রত্যয়ন প্রদান করেছেন এই অসাধু কর্মকর্তা। এসএইড সার্জিক্যাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এসব অটোফ্রেন্ড মেশিন কিনতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের খরচ হয় ২ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে মাত্র ৭০টি মেশিন পাওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটিকে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এতেও সহায়তা করেন মোঃ তসলিম উদ্দিন খান। ফলে টাকা পরিশোধ করা হলেও অদ্যাবধি বাকি মেশিনগুলো বুঝে পায়নি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।
মোঃ তসলিম উদ্দীন খানের সম্পদের হিসাবঃ মোঃ তসলিম উদ্দীন খান বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে রাজধানীতে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। শনিরআখরায় আধুনিক ফিটিংস সহ বহুতল বিশিষ্ট বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যার ঠিকানা বাড়ী নং-৪৫, রোড নং-০৩, পলাশপুর পূর্ব দনিয়া, ঢাকা। যার বাজার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। এছাড়াও গুলশান নিকেতনে ৩ হাজার বর্গফুটের ২টি ফ্ল্যাটট, আফতাব নগরে ৫ কাঠার ৩টি প্লট, বনশ্রীতে ৫ হাজার বর্গফুটের আলিশান ফ্ল্যাট, এলিয়ন ব্রান্ডের নতুন গাড়ি ও বিপুল ব্যাংক ব্যালেন্স। তার স্ত্রীর নামে গুলিস্থান সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের নীচ তলায় দোকান নং-সি-১২২ এবং দোকান নং-সি-৭৯ এই ২টি দোকান ক্রয় করেছেন। যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এছাড়া দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা দেশের টাকা কানাডায় পাচার করে গড়ে তুলেছেন আলীশান বাড়ি। যা তদন্ত করলে বেড়িয়ে আসবে। তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের ব্যাংক একাউন্টে রয়েছে কোটি কোটি টাকা যা তদন্ত করলে বেড়িয়ে আসবে।
বিতর্কিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) মোঃ তসলিম উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে ওই অভিযোগ পত্রে।
এ ব্যাপারে মোঃ তসলিম উদ্দীন খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে তিনি তার পক্ষে কোন প্রমানপত্র দেখাতে পারেননি। এ সময় তিনি আরো বলেন, আমি একজন সৎ কর্মকর্তা। আমি দীর্ঘদিন যাবত পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এ সময় তিনি কয়েকজন সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে বলেন। তারা আমার আত্নীয় হয়। তিনি আরো বলেন, আমার এখান থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। আপনি যোগাযোগ রাখবেন তা হলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। তবে তিনি বার বার তার বিরুদ্ধে সংবাদটি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।